সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য দাঁড় করানো হয়েছিল নানা ধরনের ব্যাখ্যা। হোক সে মহাজাগতিক কিংবা বাস্তব জীবন ঘনিষ্ঠ। তেমনই এক ঘটনার নাম চন্দ্রগ্রহণ৷ আজকের মূহুর্তে দাঁড়িয়ে সহজেই বলে দেওয়া যায় চন্দ্রগ্রহণ কেন হয়, কীভাবে হয়? সঠিক ব্যাখ্যা আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু আজ থেকে বহু বছর আগের সভ্যতাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ তাদের কাছে কোনো সহজ ব্যাপার বা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না৷ ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত ছিল তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। বিভিন্ন জাতি বিভিন্নভাবে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে চন্দ্রগ্রহণকে।
ইনকাদের কাছে চন্দ্রগ্রহণ আসত এক ভয়াল রূপ নিয়ে। চন্দ্রগ্রহণ শুরু হলে যখন পৃথিবীর ছায়া, ধীরে ধীর চাঁদকে গ্রাস করা শুরু করত, তখন তারা মনে করত যেন একটি জাগুয়ার (Jaguar) চাঁদকে গিলে ফেলছে। তাদের বিশ্বাস ছিল, জাগুয়ারটি চাঁদকে খেয়ে ফেলার পর পৃথিবীকে আক্রমণ করবে। তাই জাগুয়ারের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে তারা এক অভিনব উপায় অবলম্বন করত। ইনকারা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিত যাতে ভয় পেয়ে জাগুয়ারটি চলে যায়। তারা তাদের পোষা প্রাণীদের (কুকুর) দিয়ে আওয়াজ করাতো। গ্রহণ যতক্ষণ স্থায়ী হতো ততক্ষণ চলত তাদের এই আচার। যখন ধীরে ধীরে চাঁদ নিজের অবস্থায় ফিরে আসত, তখন তারা ধরে নিত তাদেরকে ভয় পেয়ে জাগুয়ারটি পালিয়েছে৷ এভাবে পৃথিবী রক্ষা পেত!
ট্রিনিটি নদীর কোল ঘেঁষে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় বাস করে এক ধরনের উপজাতি৷ এদের বলা হয় Hupa। হুপা উপজাতির বিশ্বাস মতে চাঁদের ২০ জন স্ত্রী। ২০ জন স্ত্রীর পাশাপাশি চাঁদের রয়েছে অনেক পোষা প্রাণী। এই পোষা প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি সিংহ এবং পাহাড়ি সাপ। এরা আবার অনেক ক্ষুধার্ত। চন্দ্র যখন এদের খাবার যোগাড় করতে পারে না, তখনই তারা আক্রমণ করে চাঁদকে। রক্তাক্ত হয়ে যায় চাঁদ। স্বামীর রক্তাক্ত এই অবস্থা দেখে ছুটে আসেন তার ২০ জন প্রিয়তমা৷ বহু কষ্টে ক্ষুধার্ত প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচানো যায় চাঁদকে। ধীরে ধীরে গ্রহণ শেষ হয়। চাঁদ হয়ে ওঠে সুস্থ।
চীনের পূরাণ অনুসারে চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ ঘটার জন্য দায়ী একটি স্বর্গীয় কুকুর অথবা ড্রাগন। এই ড্রাগনটি যখন চাঁদকে গিলে নেয়, তখনই গ্রহণ শুরু হয়। এই অবস্থায় ড্রাগন তাড়িয়ে চাঁদকে মুক্ত করার জন্য চীনারা বাদ্যযন্ত্র বাজানো শুরু করত৷ বাদ্যযন্ত্রের বাজনার তীব্রতার তাণ্ডবে একসময় ড্রাগনটি পালিয়ে যেত। চন্দ্র শোভা পেত আগের মতোই৷
হিন্দু পুরাণ মতে রাহু নামক অসুর যখন ছদ্মবেশে দেবতাদের আসরে অমৃত পান করতে যায়, তখন চন্দ্র ও সূর্য তার ছদ্মবেশ চিনে ফেলে৷ রাহুর এহেন অপরাধের জন্য ব্রক্ষ্মা তার মাথা থেকে ধড় আলাদা করার আদেশ দেন। কিন্তু ততক্ষণে রাহু অমৃত পান করে ফেলার কারণে রাহু জীবিতই থেকে গেল কিন্তু মাথা ও দেহ বিচ্ছিন্ন হিসেবে৷ তখন থেকেই রাহুর সাথে সূর্য ও চাঁদের বৈরিতা। এই বৈরিতার ফলশ্রুতিতে রাহুর মস্তক ভাগ যখন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সূর্য, চন্দ্রের কাছে ছুটে যায়, তখন সূর্য, চাঁদকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু রাহুর তো পেট নেই। তাই সূর্য, চাঁদ গিলে ফেললেও সেগুলো গলার কাটা অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসে। এই মুখে নেওয়া থেকে বেরিয়ে আসার সময়টাকেই হিন্দু পুরাণে গ্রহণ বলা হয়।
এছাড়া আরও অনেক উপকথা আছে। মেসোপটেমিয়ানরা চন্দ্রগ্রহণকে তাদের রাজার প্রতি অসম্মান মনে করত, রাজাকে লুকিয়ে রেখে অভিনব উপায়ে চন্দ্রগ্রহণের সময়টি অতিবাহিত করত তারা। এ সময় আসল রাজাকে তারা লুকিয়ে রাখত অথবা সাধারণ নাগরিকের বেশভূষায় সজ্জিত করত। অন্যদিকে একজন সাধারণ লোককে নকল রাজা সাজানো হতো। এভাবে চাঁদকে ধোঁকা দিতো তারা। চন্দ্রগ্রহণ শেষ হলে বেশিরভাগ সময় নকল রাজাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হতো এবং আসল রাজাকে আবার সিংহাসনে বসানো হতো।
অ্যাজটেক সভ্যতা পৃথিবীর ইতিহাসে জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। চন্দ্রগ্রহণের সময় নানা ধরনের বিধি নিষেধ ও পালন করত তারা (যা আজও বহু দেখা যায়)। এছাড়া ভাইকিং, মায়ানদেরও ছিল নিজস্ব পদ্ধতি এবং আচার। আফ্রিকার টোগো (Togo) এবং বেনিন (Benin) অঞ্চলের বাটাম্বালিম্বা (Batammaliba) জাতির লোকেরা চন্দ্রগ্রহণকে সূর্য এবং চন্দ্রের যুদ্ধ বলে মনে করত। তখন লোকেরা যুদ্ধ থামানোর উদ্দেশ্য নিয়ে এক জায়গায় সমবেত হতো। একসময় যুদ্ধ থেমে যেত।
এরকম বহু উপকথা রচিত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে। তবে আজকের পোস্টের উদ্দেশ্য নিছকই এসব কুসংস্কার নিয়ে না। প্রাচীন মানুষের কাছে যে ব্যাপারটি সবচেয়ে ভয়ের ছিল, সেটি হলো চাঁদের রক্তিম রূপ ধারণ করা। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ কেন হয় তা আমরা প্রায় সবাই জানি। তাই এ ব্যাপারটি বলা বাহুল্য মনে হতে পারে। মূল প্রশ্ন হলো, পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ রক্তের মতো লাল হয় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের পৃথিবীতেই। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে। এসময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এর ভিতর দিয়ে আলোকরশ্মি গমন করে। এসময় বায়ুমন্ডলের ধুলিকণাসহ বিভিন্ন উপাদান থাকার ফলে আলো বিচ্ছুরিত হয়। আলো বিচ্ছুরণ যখন হয় তখন কোনো বড়ো প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন আলো না হলেও আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি দৈর্ঘ্যের সমান বহু প্রতিবন্ধকের মুখোমুখি হয়। যার ফলে প্রযোজ্য হয় রিলের (Rayleigh) বিচ্ছুরণ সুত্র।
রিলের বিচ্ছুরণ সুত্রের মূলনীতি এমনভাবে লেখা যায়:
বিচ্ছুরণের মাত্রা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্ঘাতের ব্যাস্তানুপাতিক। অর্থাৎ সহজ ভাষায় তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম, আলোক বিচ্ছুরণ তত বেশি।
আমরা জানি, সূর্যের আলোর মধ্যে রয়েছে বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল বর্ণের আলোর সংমিশ্রণ। এর মধ্যে বেগুনী আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান সবচেয়ে কম। যার ফলে বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে গমন করার সময় বেগুনি বর্ণের আলো বেশি পরিমাণ বিচ্ছুরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। লাল বর্ণের আলোক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান বেশি। ফলে অন্যান্য আলোর তুলনায় কম বিচ্ছুরিত/কম ছড়িয়ে পড়ে গমন করতে পারে। এই লাল আলো চাঁদের বুকে আপতিত হয় এবং আপতিত আলোর নির্দিষ্ট শতাংশ আমাদের চোখে প্রতিফলিত আলোকরূপে আসলে আমরা চাঁদকে লাল দেখতে পাই। সূর্য ডোবা কিংবা ওঠার সময় দিগন্ত লাল হয়ে যাওয়ার কারণও একই। শুধু পার্থক্য হলো, সূর্য ডোবা বা ওঠার সময় আলো সরাসরি চোখে আসলেও পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় প্রতিফলিত আলো চোখে আসে।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ যে সবসময় রক্তিম থাকে তা নয়। কমলা, কমলা-হলুদ ইত্যাদি রঙেরও হয়। মূলত কোন রং হবে সেটা নির্ভর করে বায়ুতে কোন উপাদান আছে কী পরিমানে তার ওপর। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণে কী রং দেখাবে সেটা পরিমাপ করার জন্য Danjon scale নামে এক পরিমাপ পদ্ধতি আছে। এটা এখন আলোচনা করব না সামনের জন্য তুলে রাখলাম বিস্তৃত আলোচনার জন্য।