মের্ক কোয়াল্সকি, হামবেল্থ ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিনের একজন এস্ট্রোনমার। চাকরি করেন নিউট্রিনো অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে। পেশাগত দিক থেকে জোর্ত্যিরবিজ্ঞান তো আছেই, তাছাড়াও ব্যাক্তিগত ভাবে জোর্ত্যিরবিজ্ঞানের প্রতি তার অসীম আগ্রহ। সময়টা ২০১৪। প্রফেসর মের্ক তার কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে একটা জুয়া খেলার প্রস্তুতি নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ব্ল্যাকহোল থেকে আসা নিউট্রিনো পরীক্ষা করা। কারণ সূদুর ইজরায়েলের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্ল্যাকহোল থেকে নির্গত নিউট্রিনোয় অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা গেছে। কাজে নেমে পড়েন অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টের ৬০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, যাই হয়ে যাক এই অস্বাভাবিকতা কী? আর কেন হচ্ছে তার উত্তর চাই। [2]
ব্ল্যাকহোল কী?
ব্ল্যাকহোল স্পেসের আর পাঁচটা অবজেক্ট বা বস্তুর মতোই একটা ফিজিক্যাল অবজেক্ট। শুনতে সাধারণ আর স্বাভাবিক মনে হলেও ব্ল্যাকহোল অত্যন্ত অস্বাভাবিক বস্তু। এর এই অস্বাভাবিকতার কারণ তার বিশাল পরিমাণের ভর, আসীম মানের মধ্যাকর্ষণ ফিল্ড আর ঘনত্ব। এর মধ্যাকর্ষণ ফিল্ডের তীব্রতা এতই বেশি যে মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম বস্তু আলো এর ফিল্ডে ঢুকে পড়লে আর বের হতে পারে না, আলোকে গিলে নেয় এই ব্ল্যাকহোল।
ব্ল্যাকহোলের বাইরে একটা লেয়ার আছে যার নাম ইভেন্ট হোরাইজন– এটি আবার এস্কেপ ভিলোসিটি বা মুক্তি বেগের সাথে রিলেটেড। তাই মুক্ত বেগ কী সেটা আগে জানা দরকার। মুক্তি বেগ হচ্ছে “যদি কোনো বস্তুর অপর একটা কাঠামো বস্তুর সাপেক্ষে গতিশীল হয় তাহলে যে বেগে ঐ বস্তু চললে কাঠামো বস্তুর মধ্যাকর্ষণ ফিল্ড থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, ঐ বেগ কে কাঠামো বস্তুর সাপেক্ষে মুক্ত বেগ বলে।”
ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হোরাইজন এমন একটা জায়গা যেখানে কোনো একটা বস্তু গিয়ে ফিরে আসতে চাইলে তার মুক্তি বেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হতে হবে। এখন কথা হচ্ছে আইনস্টাইন সাহেব বলে গেছে আলোর চেয়ে দ্রুত গতির বস্তু হতে পারে না। অতএব সোজা কথা বললে ইভেন্ট হোরাইজন এমন একটা জায়গা যেখানে কোনো বস্তু গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না। ততক্ষণে পযর্ন্ত পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার বেগ আলোর চেয়ে বেশি হচ্ছে। [4]
কী হবে যদি একটা তারা, ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হোরাইজনে ঢুকে পড়ে?
২০১৯ সালের চিলির অ্যাটাকামা মরুভূমি স্পেস অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়, যা অ্যাস্ট্রোনমারদের রোমাঞ্চিত হতে বাধ্য করে। কয়েক মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একটা ব্ল্যাকহোল থেকে অদ্ভুত এক সিগন্যাল ধরা দিলো তাদের টেলিস্কোপে। এমন সিগন্যাল তখনই ধরা পড়ে যখন একটা ব্ল্যাকহোল কোনো একটা তারাকে গিলে নেয়। তার মনে নিশ্চয়ই ঐ ব্ল্যাকহোল একটা তারাকে গিলে ফেলেছে।
একটা তারা যখন ইভেন্ট হোরাইজন কাছে পৌচ্ছায়, তখন তারার বাইরের লেয়ারের পার্টিকেলগুলোকে ব্ল্যাকহোল তার মধ্যাকর্ষণ ফিল্ডের প্রভাবে গিলে খেতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ তারাটিকে গিলে নেয়। সম্পূর্ণ তারা গিলে নিলেও তারার কিছু অংশ যাকে বলে স্টার ডাস্ট সেগুলো ইভেন্ট হোরাইজন চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। চিলির অবজারভেশনে দেখা গেল সত্যি সত্যি সেরকম ধুলো–বালি ছড়িয়ে আছে ব্ল্যাকহোলের পাশ জুড়ে। তাহলে সত্যিই কি সে একটা তারা গিলে ফেলেছে? [5]
একই সময়, বার্লিন শহর যখন ঘুমে অবচেতন তখন প্রফেসর মের্ক কোয়াল্সকির এক সহকর্মী মনিটর স্ক্রিনে নির্ঘুম তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ তার চোখ চকচক করে উঠলো। কয়েকঘন্টার মধ্যে ৬০ জন গবেষক হাজির। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অ্যানালাইস করতে লাগলেন সেদিনের তথ্য। বার্লিনে যখন ভোর হচ্ছে, তখন প্রফেসর মের্কের টিম বুঝতে পারলেন তারা জুয়া খেলায় জিতে গেছেন। অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন নিউট্রিনো ধরা পড়েছে তাদের টেলিস্কোপে। আরো একবছর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অ্যানালাইস করার পর, ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারা ন্যাচার জার্নালে পেপার পাবলিস করলেন। ৫ বছর আগে ইজরায়েলে যে অস্বাভাবিকতা দেখা গেছে সেগুলো মূলত খুব উচ্চ শক্তি সম্পন্ন নিউট্রিনো। [1]
তারায় মূলত নিউট্রিনো তৈরি হয়। ব্ল্যাকহোল যখন একটা বস্তু কে গিলে নেয় তখন সে প্রচুর পরিমাণে শক্তি বিকিরণ করে। গিলে নেয়া তারায় যে নিউট্রিনোগুলো তৈরি হচ্ছিল ওগুলো ব্ল্যাকহোলের বিকিরিত শক্তি নিয়ে এসে আছড়ে পড়ছিল পৃথিবীতে। গত ৩ জুন, শেষ উপসংহার টেনে, পুরো ঘটনার ব্যাখা দেন প্রফেসর মের্ক কোয়াল্সকি ও তার টিম। [6]
তথ্যসূত্র
- https://www.nature.com/articles/s41550-020-01295-8
- https://www.desy.de/about_desy/lead_scientists/marek_kowalski/index_eng.html
- https://www.space.com/nasa-released-black-hole-video-postcards.html
- https://www.space.com/black-holes-event-horizon-explained.html
- https://www.space.com/36209-astronomers-will-peer-inside-black-event-horizon-telescope.html
- https://journals.aps.org/prl/abstract/10.1103/PhysRevLett.128.221101