লেখিকা : আবিরা আফরোজ মুনা
জামাল নজরুল ইসলাম, তার জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯ সালে। তিনি ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং একজন বিশ্বতত্ত্ববিদ ছিলেন । তার মায়ের নাম রাহাত আরা বেগম এবং তার বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম। সারা বিশ্বে জামাল নজরুল ইসলাম, জেএন ইসলাম নামে পরিচিত ছিলেন এবং বিজ্ঞানীদের কাছে বাংলাদেশ জেএন ইসলামের দেশ হিসেবে পরিচিত। জামাল নজরুল ইসলাম মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত।
তার বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তার বাবা কলকাতায় বদলি হন। জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীতে শিশু বিদ্যাপীঠে ভর্তি হন। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়েন। পরবর্তীতে আবার মডেল স্কুলে ফিরে যান। কলকাতায় মডেল স্কুলের পর চট্টগ্রামে চলে আসেন। এখানে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেন। চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় তিনি এত ভালো করেছিলেন যে, শিক্ষকৃবন্দ তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে এক শ্রেণি উপরে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। অনেক অতিরিক্ত জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। নবম শ্রেণিতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। এ সময় নিজে নিজে অনেক অঙ্ক করতেন। বিভিন্ন বই থেকে সমস্যা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন যা পরবর্তীতে তার অনেক কাজে আসে। হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই কেবল গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান। এখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন। এই কলেজের একজন শিক্ষককে তিনি নিজের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার নাম “ফাদার সোরে”। গণিতের জটিল বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন বলেই জে এন ইসলাম তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সোরে তার কাছে গণিতের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন, ইসলাম আগ্রহভরে তা শেয়ার করতেন। সোরের সাথে ইসলামের এই সম্পর্কের কারণ বলতে গিয়ে ইসলাম বলেন,
গণিতকে এমনিতেই অনেকে ভয় পেতাম। কিন্তু এটির প্রতিই ছিল আমার অসীম আগ্রহ। এ কারণেই বোধহয় তিনি আমাকে পছন্দ করতেন।
ফাদার সোরে তাকে ডাকতেন জীবন্ত কম্পিউটার বলে। অন্যান্য বিজ্ঞানী যেখানে কম্পিউটার ও ক্যালকুলেটর নিয়ে কাজ করতেন সেখানে জেএন ইসলাম এগুলি ছাড়াই বেশ বড় বড় হিসাব মুহূর্তে করে দিতেন। তিনি বলতেন, কম্পিউটার আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। তবে তিনি কম্পিউটারের সাধারণ প্রয়োজনীয়তা কখনো অস্বীকার করেননি।
বিএসসি শেষে ১৯৫৭ সালে তিনি কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি (১৯৫৯) অর্জন করেন। তারপর এখান থেকেই মাস্টার্স (১৯৬০) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি থেকে গণিতে ট্রাইপস পাস করতে লাগে তিন বছর। জেএন ইসলাম তা দুই বছরে শেষ করে বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিলেন।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক কোটা খালি না থাকায় তিনি গণিত বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা রিসার্স সেন্টার ফর ম্যাথম্যাটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস)।
২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবী অচিরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে- এ রকম একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে! বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ দেশে এই আতঙ্ক মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়ার আগেই আমাদের সব উদ্বেগকে প্রশমিত করেছিল তিনি। কোনো দৈবজ্ঞান নয়, তিনি রীতিমতো গণিতের হিসাব কষে জানান যে, আমাদের সৌরজগতের অধিকাংশ গ্রহ প্রাকৃতিক নিয়মে একই সরলরেখা বরাবর এলেও এর প্রভাবে এই গ্রহে অস্বাভাবিক কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই।
জামাল নজরুল ইসলাম বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য ৬টি বই লিখেছেন। তবে বই, গবেষণা ও সম্পাদনার বিস্তারিত তালিকা আরো বিষদ। এদের মাঝে ৩টি বই বিশ্ববিখ্যাত। ক্যামব্রিজ ও হার্ভার্ড সহ বেশ কয়েকটি নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বই পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। তার লেখা বই ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ ফরাসি, জাপানী, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ই তার প্রথম বই, যা ১৯৮৩ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বইটি তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। তার এই বইটির বিষয়বস্তু মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ তথা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি। বইটি প্রকাশের আগে ‘স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ’ নামে একটি বিখ্যাত ম্যাগাজিনে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে তিনি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন। মূলত সম্পূর্ণ বইটির সারমর্ম নিহিত আছে এই প্রবন্ধে। এ সম্বন্ধে জামাল নজরুল ইসলাম তার বইয়ে যে মুখবন্ধ লিখেছেন তা হলো:-
১৯৭৭ সালে “মহাবিশ্বের সম্ভাব্য অন্তিম পরিণতি- Possible ultimate fate of the universe” শিরোনামে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেছিলাম। কোয়ার্টারলি জার্নাল অব রয়্যাল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল। আমার কিছু সহকর্মীর নিকট গবেষণাপত্রটি বেশ আগ্রহোদ্দীপক ও চমৎকার বলে মনে হয়েছে। এর পরপরই বিজ্ঞানের জগতে আবির্ভাব ঘটেছে স্টিভেন ওয়াইনবার্গের সাড়া জাগানো বই দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস। একদিকে আমার গবেষণাপত্র নিয়ে সহকর্মীরা বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে মহাবিশ্বের শুরুর দিক নিয়ে ওয়াইনবার্গ বই লিখেছেন। এই দুই দিক মিলিয়ে ভাবলাম, মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি নিয়ে একটি বই লিখলে চমৎকার হয়। এর পরপরই স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ নামে একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী থেকে আমাকে একটি অনুরোধ করা হয়। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে আমার গবেষণাপত্রটি যেন সকলের উপযোগী করে সহজসাধ্য ভাষায় লিখে দেই তাদের জন্য। ঐ সাময়িকীতে লেখাটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি সংখ্যায়। লেখার শিরোনাম ছিল ‘The ultimate fate of the universe’।
এটি প্রকাশের পর যে সাড়া পেয়েছি তা-ই আমাকে এই বিষয়ে একটি বই লিখতে প্ররোচিত করেছে। এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করে একটি বই লিখে ফেললে মন্দ হয় না। এসব ঘটনার মিলিত ফলাফলই হচ্ছে বর্তমান এই বই।
তার উল্লেখযোগ্য আরেকটি বই হচ্ছে Rotating Fields in General Relativity এবং আরেকটি An Introduction to Mathematical Cosmology। অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’ তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বইটির গ্রহণযোগ্যতা ও চাহিদা ব্যাপক। তিনি বাংলায়ও উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন ‘কৃষ্ণ বিবর’, ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’ এবং ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’। তার লেখা ‘ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা’ নামে চমৎকার একটি সিরিজ প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি। ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজের অধীনে প্রকাশিত বইগুলোতে সংক্ষেপে কিন্তু পরিপূর্ণভাবে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। জামাল নজরুল ইসলামের কৃষ্ণ বিবরও এই সিরিজেরই একটি বই।
বিজ্ঞানের বাইরেও ছিল তার পদচারণা। গণিত, পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞান, সঙ্গীত ও অর্থনীতিতেও ছিল তার বিচরণ। এসব বিষয়ে তার লেখা বই ও গবেষণাগুলোই প্রমাণ। তার লেখা ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’ এবং ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’ বই দুটিতেও তার লেখা ও পদচারণার পরিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তার লেখা অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ইকনোমিক্স ও কনফাইনমেন্ট অ্যান্ড শ্রোডিংগার ইকুয়েশন ফর গাউস থিওরিস তার আরো দুটি উল্লেখযোগ্য বই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।
বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্য লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি এক অনন্য নাম। জামাল নজরুল ইসলাম এই প্রসিডিংসয়ে ধারাবাহিকভাবে পরপর ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এখানে গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে গেলে আবার রয়্যাল সোসাইটির কোনো ফেলো সদস্যের রিকমেন্ডেশন লাগে। জামাল নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে রিকমেন্ডেশন করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও ফ্রেড হয়েল। পরপর প্রকাশ করা ছয়টি গবেষণাপত্রের বিষয় ছিল ‘অন রোটেটিং চার্জড ডাস্ট ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও চার্জিত বস্তু নিয়ে করা গবেষণার উপর ভিত্তি করেই লিখেন ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামের বইটি। ১৯৮৫ সালে এটি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য প্রসিডিংসয়ে প্রকাশিত তার এই গুরুত্বপূর্ণ ও উঁচু মানের গবেষণার জন্য ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি তাকে অত্যন্ত সম্মানজনক ডিগ্রি ডক্টর অব সায়েন্স প্রদান করে।
তার চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিল দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এই পরোক্ষ অবদান ভুলার মতো নয়। ১৯৮৪ সালে কেমব্রিজের সোয়া লাখ টাকা বেতনের অধ্যাপনার চাকরীটি ছেড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র হাজার তিনেক টাকা বেতনে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি। শুধু নিজে নয়, তার প্রিয় সবাইকেই তিনি পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক ও শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। ইসলাম তৎক্ষণাৎ তাকে দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দেন।
কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামের দেশে প্রত্যাবর্তন এতটা সহজ ছিল না। তাকেও নিজের দেশের মাটিতে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৮১ সালের দিকে দেশে ফিরে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় তার বেতন ছিল ২৮০০ টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কিছুতেই রাজি হয়নি তাকে তিন হাজার টাকা বেতন দিতে। এই বেতনেই তিনি অধ্যাপনা করে যান। এখানে এক বছর অধ্যাপনা করার পর গবেষণার কাজে এবং পারিবারিক প্রয়োজনে আবার লন্ডনে ফিরে যাবার প্রয়োজন দেখা দেয় তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণার জন্য বাইরে গেলে কর্তৃপক্ষ ছুটি প্রদান করে এবং ফিরে আসা পর্যন্ত চাকরি বলবৎ থাকে। এর জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটির আবেদন করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দিচ্ছিল না। উপায় না দেখে চাকরি ছেড়ে চলে যান তিনি। দুই বছরে সেখানে তার গবেষণা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে তিনি সেখানকার বাড়ি-ঘর বিক্রি করে স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসেন। এরপর অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বেতন বাড়িয়ে তিন হাজার টাকায় উন্নীত করে আর মাঝখানের সময়টিকে শিক্ষা ছুটি হিসেবে গ্রহণ করে।
দেশের মাটিতে তার ভোগান্তি এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। পরিস্থিতি সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশিদের একটি লেখায়। জামাল নজরুল ইসলাম ও হারুন অর রশিদের মাঝে ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক।হারুন অর রশিদ নিজেও একজন গুণী ব্যক্তিত্ব। অধ্যাপক ইসলামের মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করে কালি ও কলম নামের এক সাহিত্য ম্যাগাজিনে তিনি লিখেছেন-
জামালের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৮৪ সালে, যখন তিনি কেমব্রিজ থেকে চট্টগ্রামে চলে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। একদিন তিনি টেলিফোনে আমাকে লন্ডন থেকে জানালেন যে, তিনি বাংলাদেশে চলে আসতে চান। আমি বলেছিলাম, ‘এটা নিশ্চয়ই খুব ভালো সিদ্ধান্ত। তবে তিনি যদি তার দরখাস্তটি অবিলম্বে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন, তাহলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে আলাপ করে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দিতে পারি।’
তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা আমি শুনতে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, তিনি ঢাকায় যাবেন না, তিনি চট্টগ্রামে যাবেন। কেননা সেখানে রয়েছে তার পৈতৃক ভবন। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, মনে হয় না, চট্টগ্রামে তিনি খুব ভালো ছাত্র পাবেন এবং হয়তো সেখানে তার গবেষণাকর্ম ব্যাহতই হবে। কিন্তু তিনি সে-কথা মোটেই কানে তুললেন না। তার কথা ছিল একটাই যে, আমি যেন তার দরখাস্তটি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করি। আমি তাই করেছিলাম। এক সকালে ট্রেনে চট্টগ্রামের টিকিট কিনে চট্টগ্রাম পৌঁছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলেছিলাম, ‘জামাল নজরুল ইসলাম এদেশের সম্পদ – তাকে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা আপনাদেরই সৌভাগ্য।’ উপাচার্য করিম সাহেব আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, জামাল নজরুল ইসলামের জন্য একটি অধ্যাপক পদ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অবিলম্বে সৃষ্টি করে তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে।
দুঃখের বিষয়, ঢাকায় ফিরে এসে কয়েকদিন পরে খবর পেলাম যে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পদ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। তাই কিছুদিন পরে গণিত বিভাগেই একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তাও দ্বিতীয়বার আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ করার পর। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং অকুণ্ঠ সহযোগিতা অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যোগদান করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
জামাল নজরুল ইসলাম নির্দ্বিধায় আমাদের দেশের একজন সম্পদ ছিলেন। তার অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়। তিনি ২০০০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক পান। ২০০০ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন। ড. ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল অ্যান্ড ফিজিকাল সায়েন্সের গবেষক এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।