ড. খোন্দকার সিদ্দিক-এ-রব্বানী
আমি বিশ্বাস করি, তোমাদের প্রত্যেকের একজন গবেষক হওয়ার সক্ষমতা আছে এবং তা তোমার বাড়িতে থেকেই পূর্ণ করতে পারো। যদি তুমি কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে থাকো তবে তোমার জন্য নানান সুবিধা উন্মুক্ত হবে, কিন্তু তোমার কাছে যা সম্বল আছে তা ব্যবহার করেই শুরু করতে হবে। নাহলে দেখা যাবে তুমি অন্যদের উপর দোষ চাপাচ্ছ। তোমাকে তোমার নিজের জীবনের ও কৃতকাজের জন্য দায় নিতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধৈর্য্য ধারণ করা। ‘চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে কিছু অর্জন করতে না পারলে তুমি ভবিষ্যতেও আর কিছু পারবে না’ লোকদের এরকম কথার কারণে তুমি নিরাশ হয়ে যেও না। আবার খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যেতে চেও না। একটি প্রবাদ আছে, ‘ফল যখন পেঁকে যায়, তখন এর সুবাস আপনা আপনি চারপাশে ছড়িয়ে পরে।’ আমাদের মত প্রাচীন সভ্যতার জ্ঞানলব্ধ দর্শন একটি টেকসই বিশ্ব তৈরিতে পথ দেখাতে পারে। অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ের সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে পাশ্চাত্য যেসব দর্শনকে তুলে ধরছে তা বর্তমানে আমাদের পৃথিবীর অস্তিত্বকেই সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছে।
এটা মনে করো না যে তোমার একটি চৌকশ ধারণা দেখে সারা বিশ্ব তোমাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে। তোমাকে ধারণাটির প্রাথমিক সফলতা দেখাতে হবে, এবং তা করতে হবে নিজের চেষ্টায়, নিজের সংস্থান দিয়েই। তখন দেখবে মানুষ এগিয়ে আসছে, খুঁজে খুঁজে তোমাকে সহায়তা করতে আসছে, বিনিয়োগ করতে আসছে। দীর্ঘ ৪০ বছর একাধারে কাজ করার পর আমি নিজেকে আজ এই অবস্থানে দেখতে পাচ্ছি, আমার সুবাস ছড়াচ্ছে। তোমরা যে আমার এই অনুচ্ছেদটি পড়ছ তাও এই সুবাসেরই একটি উদাহরণ।
তোমাকে বাস্তবতাও স্বীকার করে নিতে হবে। বেঁচে থাকতে তোমার একটি অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। তাই এমন যেকোনো একটি কাজ নাও যা তোমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে ও কিছু অর্থ থেকে যাবে। যেকোনো অবস্থানে থেকে একজন সফল গবেষক হওয়ার জন্য এখানে কিছু বিষয় উল্লেখ করছি।
(ক) খুবই আকর্ষণীয়, নাম শুনলেই কাজ করার ইচ্ছা জাগে এমন গবেষণা দিয়ে নিজেকে আটকে ফেলো না। এমন কিছু নিয়ে কাজ করো যা সহজ, যা তোমার আশেপাশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়, যা নিত্যদিনের সমস্যার সমাধান দেয়। দেখবে আশেপাশের অনেকেই তোমার সমাধানটি কিনতে চাইবে। এভাবে তুমি বেঁচে থাকার জন্য কিছু আয় করতে পারো। তোমার তৈরি পণ্যটি একদম তৈরির খরচে বেচবে না, বাজার বুঝে কিছুটা লাভ রাখবে, যা তোমাকে নিজের খরচ চালাবার পর এ পণ্যটি নিয়ে আরো গবেষণায় সাহায্য করবে। তুমি যখন তোমার পণ্যটি বিক্রি করবে তখন কেউ কেউ এর খুঁত বের করবে, এর কোথায় কোথায় সমস্যা তা তোমাকে বলা হবে, কখনো কখনো তোমার পণ্যের কিছু অংশ সম্পূর্ণ নতুনরূপে ডিজাইন করতে হবে। তখন তুমি কাজে লেগে পর ও গবেষণা করে বের কর এসকল সমস্যা কীভাবে দূর করা সম্ভব? এভাবে তোমার পণ্যের ক্রুটি বিচ্যুতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনো ও পণ্যের মান বৃদ্ধি করো। এভাবে তুমি একসময় আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, জীবন ধারণের জন্য তুমি যে কাজটি ধরেছিলে তা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণরূপে গবেষণায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারবে। এছাড়াও তুমি যদি তোমার পণ্যে তোমার ও তোমার সহযোগীদের সৃজনশীলতা দেখাতে পারো তবে দশ বারো বছর পর নিজেকে বিশ্বের বা কোনো এক অঞ্চলের আবিষ্কারকদের মধ্যে নেতৃত্বের স্থানে দেখতে পাবে। তুমি বুঝতে পারবে তুমি যা করছ তা সকলে প্রশংসা করছে।
(খ) এমন কিছু করার চিন্তা কর যেটিতে তোমার জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সফলতা অর্জন করতে পারবে এবং যার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও যন্ত্রপাতি তোমার আয়ত্তের মধ্যে আছে। তারপর শুরু করে দাও। আমি এই ‘শুরু করে দাও’ শব্দগুচ্ছের উপর বেশি জোর দেই, কেননা অনেক নতুন নতুন আইডিয়া সেই সময়ে আসে যখন তুমি কোনো কাজ শুরু কর।
(গ) উপরের এই পদ্ধতিটি তোমার জন্য সহজেই সাফল্য নিয়ে আসতে পারে, যা তোমাকে কিছু অর্জনের খুশি এনে দিবে এবং তোমার উপর আশেপাশের মানুষের আস্থা তৈরি হবে। যখন লোকেরা দেখবে তুমি খুবই কার্যকর কিছু কাজ করতে পারো, তখন লোকেরা তোমার কাজকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে এবং স্বেচ্ছায় তোমার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে।
উপরের পরামর্শের উপর ভিত্তি করে তোমাকে একটি উদাহরণ দেই- ধর তোমার একটি রেফ্রিজারেটর রয়েছে এবং তুমি বাসা থেকে অফিসে বোতলে করে যে পানি নিয়ে যাও তুমি চাও সে পানি নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও ঠান্ডা থাকুক। তুমি এই কাজটি সফল করতে পারো তোমার বোতলকে একটি পুরু প্লাস্টিক ফোম (কর্ক শিট) দিয়ে মুড়ে দিয়ে। তারপর বাইরে একটি প্লাস্টিকের বা পাটের ব্যাগ দিয়ে সুন্দর করে ঢেকে দিলে তোমার কাজ মোটামুটি শেষ। এবার তোমার এই কমদামী ফ্লাস্কটি দিয়ে কিছু গবেষণা করা দরকার। এই টাইপের অনেক কিছুই বিজ্ঞান মেলায় দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাদের সাথে তোমার তফাৎ হবে এই যে, তারা গবেষণা করেনি, তুমি গবেষণা করবে। তোমার গবেষণার জন্য তুমি কিছু হিসাব ও মান নাও এবং দেখো যে তোমার অফিসের তাপমাত্রায় ফ্লাস্কের ভিতরের ঠান্ডা পানির তাপমাত্রা কীভাবে সময়ের সাথে বাড়ে। এগুলো পর্যালোচনা করো। এরপর চারদিকে প্যাঁচানো কর্কশীটের পুরুত্ব বাড়িয়ে কমিয়ে দেখো তা তাপমাত্রার উপর কী প্রভাব ফেলে। এরপর তোমার জ্ঞান ব্যবহার করে তুমি তোমার এই পরীক্ষা হতে প্রাপ্ত মানগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করো। এ থেকে তুমি তোমার ফ্লাস্কের ডিজাইন কীভাবে পরিবর্তন করতে হবে তা বুঝে যাবে। এরপর চিন্তা কর কোন পদার্থ দ্বারা বোতল মুড়ে দিলে
খরচ একটি সীমিত পর্যায়ে থাকবে, ব্যবহারকারী ব্যবহার করে মজা পাবে। দেখ তো, তুমি একটি গবেষণা করে ফেলেছ, এতে কি অনেক টাকা লেগেছে?
যখন তুমি নিজেই এই পণ্যটি ব্যবহার করা শুরু করবে তখন তুমি দেখবে বাকিরাও তোমার এই প্রোডাক্টটি ব্যবহার করতে চাচ্ছে। তখন তুমি এরকম আরো কিছু পণ্য বানিয়ে তা বিক্রি করা শুরু করো এবং আমি পূর্বে বিক্রি করার যে নীতিমালা বলেছি তা অনুসরণ করো। তুমি জানো না যে তুমি অবশেষে কি পাবে, যতই দিন যাবে ততই নতুন নতুন চিন্তা আসবে।
যদি তুমি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকো তাহলে একই রকমের একটি সহজ সমস্যার সমাধানে কাজ শুরু করো। তুমি যখন সেই সহজ সমাধানে সাফল্য অর্জন করবে তখন তোমার সিনিয়ররা তোমার কাজে আগ্রহ অনুভব করবে। তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা কর যে বিষয়টি সকলের কাছে পৌছে দেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এই প্রোডাক্টটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পৌছে দিতে অনুরোধ করো। যদি কোনো সাড়া না পাও তবে তুমি নিজেই এর কিছু কপি তৈরি করা শুরু কর এবং নিজের আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতদের মধ্যে বিক্রি করা শুরু করো। যা টাকা পাবে তা সংরক্ষণ করে রাখো কেননা তোমার কাজকে সম্প্রসারণ করতে এই টাকা কাজে লাগাবে।
আমার দৃষ্টিতে এটা কোন অনৈতিক কাজ নয় কারণ তোমার এই উদ্যোগই একসময় পুরো জাতির জন্য কল্যাণকর হবে। এ অর্জন তোমার সিনিয়রদের ভাবনার চেয়েও অনেক বড়ো। অন্যথায় তোমার গবেষণা ল্যাবরেটরির মাঝেই চাপা পড়ে থাকবে। তুমি যদি বিসিএসআইআর (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) এর দিকে লক্ষ্য করো, তাহলে দেখবে, সেখানে যেসব পণ্য আবিষ্কার ও উন্নয়ন করা হয়, সেগুলো তারা নিজেরা বাজারজাত করে না। ফলশ্রুতিতে পণ্যগুলো বিকাশের পিছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয়, তা কোনো কাজে আসে না।
তুমি যদি দেখতে পারো তোমার পণ্যটির ভালো চাহিদা রয়েছে তবে জমানো টাকা দিয়ে একটি ছোটোখাটো প্রতিষ্ঠান খুলে তার উৎপাদন ও বিপণন শুরু কর। এক্ষেত্রে আমার উপদেশ হবে কোনো বন্ধু বা কোনো সম্পদশালী কাউকে ব্যবসার শেয়ার হোল্ডার হিসেবে না নেওয়া। কেউ যদি উপহার হিসেবে বা ঋণ হিসেবে কিছু দেয় তবে তা তুমি নিতে পারো। তোমার ব্যবসার উপরে তুমি কাউকে আধিপত্য বিস্তার করতে দিয়ো না। অনেক ভালো ভালো ব্যবসাও নিজের পার্টনারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বলবে, ‘তুমি একজন বিজ্ঞানী, ব্যবসা করছ কেন? তোমার পণ্যটি কোনো ব্যবসায়ীকে দিয়ে দাও।’ আমি আমার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমি এ সব উপায়ে চেষ্টা করেছি, কোনোটিতেই সফলতা পাই নি। শেষ পর্যন্ত আমি যখন নিজেই একজন খন্ডকালীন উদ্যোক্তা হয়েছি তখন সফলতা পেয়েছি। আমার প্রথম সফল ফ্যাক্টরি ছিলো আমার বাসার বৈঠকখানা। এখন বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি কিছু সফল প্রযুক্তিগত ব্যবসার উদাহরণ যেগুলো উদ্ভাবকেরা নিজেরাই সৃষ্টি করেছিলেন। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, আই বি এম, সনি, মার্কোনি, এডিসন, জেমস ওয়াটসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের পিছনের গল্পটা কিন্তু এমনই।
নিজস্ব গবেষণা এবং উন্নয়নের মাধ্যমে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তারাই গবেষণা এবং ধৈর্যের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই পরবর্তী প্রজন্মের গবেষক, বিজ্ঞানীরা সহযোগিতা পাবে। তবে আমাদের দেশে এই ধরণের গবেষণা এবং উন্নয়নের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের সব বড় বা মাঝারী শিল্প সম্পূর্ণভাবে বিদেশী প্রযুক্তি নির্ভর, যেগুলোতে খুব অল্প সময়েই খরচ উঠে আসে। কিন্তু তোমার একটি নতুন প্রযুক্তির পণ্যে সফলতার জন্য যে ধৈর্য ধরতে হবে সেটি তাদের নেই। তোমার নিজস্ব প্রযুক্তির পণ্য হচ্ছে তোমার নিজের ‘সন্তান’। তোমার সন্তান যেন সফল হয় সে জন্য তোমার চেষ্টায় কোন ত্রুটি থাকবে না, সব বাধা পেরিয়ে তুমি তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর এটিই হচ্ছে যে কোন নতুন প্রযুক্তির পণ্যকে বাজারে সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মূলমন্ত্র।