“Universe didn’t start to exist to exist forever”
Matt o’dowd
মহাবিশ্ব চিরস্থায়ী নয়। আর এটি যা যা দিয়ে গঠিত সেগুলোও চিরস্থায়ী নয়। মহাবিশ্বের ভয়ানক স্থানগুলোর মধ্যে ব্ল্যাকহোল (BlackHole) অন্যতম। ভয়ানক বলতে এটি এমন এক সত্ত্বা, যার একটি নির্দিষ্ট সীমার অধিক নিকটে গেলে আপনি আর ফিরে আসবেন না। আইন্সটাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির একটি প্রেডিকশন ছিল এই ব্ল্যাকহোল। কিন্তু তা সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক। যেমন: এই ব্ল্যাকহোলের কোনো শুরু বা শেষ নেই, নেই কোনো চার্জ, নেই কোনো ঘূর্ণায়ন। একে সোয়ার্জস্কাইল্ড ব্ল্যাকহোলও বলে। মনে রাখতে হবে, এটি ব্ল্যাকহোলের একটি মডেল ছিল শুধু। যা দিয়ে ব্ল্যাকহোলের আচরণ, বৈশিষ্ট্য বুঝতে চাচ্ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। বাস্তব জগতে এর সৃষ্টি হয়, ধ্বংসও হয়। ব্ল্যাকহোল ফিজিক্সে একটি সেলিব্রেটি ফিগার। তাই, এর পরিচয় নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না।
‘তাপগতিবিদ্যার’ নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? তাপগতিবিদ্যায় ৪টি সূত্র আছে। বিজ্ঞানী জ্যাকব বেকেনস্টাইন ব্ল্যাকহোল নিয়েও ৪টি সূত্র দেন। ব্ল্যাকহোল থার্মোডাইনামিক্স-এর ভিত্তিই এই সূত্রগুলো। সূত্রগুলো সহজে বলতে গেলে–
শূন্যতম সূত্র – কোনো ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রফল সমান থাকলে তার সম্পূর্ণ ক্ষেত্রফল জুড়ে মহাকর্ষ বল সমান থাকবে।
- প্রথম সূত্র – ব্ল্যাকহোলে কোনো শক্তি প্রদান করা হলে তা ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রফল, চার্জ, ঘূর্ণায়ন পরিবর্তন করে দেয়।
- দ্বিতীয় সূত্র – ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রফলের মান স্থির থাকে অথবা বৃদ্ধি পায়। তবে কখনও হ্রাস পায় না।
- তৃতীয় সূত্র – শূন্য মানের মহাকর্ষ বলবিশিষ্ট ব্ল্যাকহোল পাওয়া সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় সূত্রটি লক্ষ্য করুন, সূত্রটি বলছে ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রফল হ্রাস পায় না। এই সূত্রে একটি ফাঁকি আছে। বেকেন্সটাইনের সূত্র মতে, ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রফল এর ভরের উপর নির্ভর করে। ভর বাড়লে ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রফল বেড়ে যায়। কিন্তু যদি ভর কমে? ব্ল্যাকহোলের ভর কি আদৌ কমা সম্ভব? এখানেই স্টিফেন হকিং তার জাদু দেখানো শুরু করেন। হকিং দেখান এক বিশেষ প্রক্রিয়ার ব্ল্যাকহোলের ভর কমতে পারে (একটি নয় বরং দুটি, আরেকটি হচ্ছে পেনরোজ প্রসেস)। হকিং বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচার-এ ‘Blackhole explosion’ নামে একটি গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি দেখান বক্র স্থান-কালে কোয়ান্টাম ফিল্ডের আচরণ দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে, ব্ল্যাকহোলও হকিং রেডিয়েশন করে ভর কমাতে পারে। যেহেতু কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি ও জেনারেল রিলেটিভিটিকে একত্র করে নতুন কোনো থিওরি এখনও দেওয়া সম্ভব হয়নি, তাই তিনি ‘Bogoliuvob transformation’ নামের একটি গাণিতিক টুলের সাহায্য নেন। যা বক্র স্পেসটাইমে কোয়ান্টাম ফিল্ডের আচরণ নিয়ে মোটামুটি ধারণা দেয়। এটি সম্পর্কে আপাতত আমাদের না জানলেও চলবে। এখন আসি হকিং রেডিয়েশন কেন হয়।
‘কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি’ নামে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী তত্ত্ব আছে। এর মতে, মহাবিশ্বে সর্বত্র বিছিয়ে দেওয়া আছে কোয়ান্টাম ফিল্ড। যে ইলেকট্রনকে আমরা অতি সূক্ষ্ম, শক্ত কণা বলে জানি তা হচ্ছে মূলত ইলেকট্রন ফিল্ডে কম্পন। এমনিভাবে কোয়ার্ক ফিল্ডের কম্পন হচ্ছে কোয়ার্ক, নিউট্রিনো ফিল্ডে কম্পন হচ্ছে নিউট্রিনো নামের কণা। এখানে ‘কোয়ান্টাম’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে কারণ এই ফিল্ডগুলো ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম থিওরি মেনে চলে। ফিল্ডগুলো সব সময় একটি নূন্যতম শক্তির স্বাভাবিক সংখ্যার গুণিতক পরিমাণ শক্তি নিয়ে কম্পিত হতে থাকে। একে বলে ফিল্ডের কোয়ান্টাইজেশন। কিন্তু মনে রাখতে হবে ফিল্ডগুলোর নূন্যতম শক্তি কিন্তু শূন্য হতে পারে না। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি মতে, কোনো সিস্টেমে উপস্থিত শক্তির পরিমাণ আমরা কখনো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে বলে দিতে পারব না। ফলে আমরা এও বলতে পারব না যে, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে যে-কোনো ফিল্ডে শক্তির পরিমাণ শূন্য। যাই হোক, যখন কোনো ফিল্ডে যে-কোনো রকমের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বাইরে থেকে শক্তি প্রদান করা হয়, তখন সে শক্তি ফিল্ডে কম্পন বৃদ্ধি করে। আর এই কম্পন বড়ো মাপের কণা হিসেবে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। এখানে একটা জিনিস আগেই পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। তা হলো ফিল্ড দ্বারা কী বোঝানো হচ্ছে? আর এই ফিল্ডের কম্পনই বা কী?
আসলে এই ফিল্ড হচ্ছে একটি ত্রিমাত্রিক সত্ত্বা যা শূন্যস্থানে অবস্থান করে। স্পেইস-এর প্রত্যেকটা পয়েন্টে একটি নির্দিষ্ট মান ধারণ করে এই ফিল্ডগুলো। শূন্যস্থানে সমান সংখ্যক পজিটিভ ফ্রিকুয়েন্সির কম্পন আর নেগেটিভ ফ্রিকুয়েন্সির কম্পন সমদশায় উপরিপাতন ঘটে। তাই, একটি অন্যটিকে প্রতিনিয়ত নাকচ (Cancel out) করে দেয়। পজিটিভ ফ্রিকুয়েন্সিগুলো ম্যাটাররূপে আর নেগেটিভ ফ্রিকুয়েন্সি অ্যান্টি-ম্যাটার রূপে দেখা যায়। সাইড নোট হিসেবে জেনে রাখতে পারেন যে, অ্যান্টিম্যাটারকে নেগেটিভ ফ্রিকুয়েন্সি না ধরে যদি সময়ের বিপরীতে যাওয়া পজিটিভ ফ্রিকুয়েন্সি ধরি তাহলেও ভুল হবে না। এবার কিছু সহজ জিনিস মাথায় রাখুন। সামনে কাজে দেবে,
- পজিটিভ আর নেগেটিভের আচরণ সম্পূর্ণ উলটো।
- পজিটিভ ফ্রিকুয়েন্সি যদি কোনো কারণে কমে যায়, সেই একই কারণ নেগেটিভ ফ্রিকুয়েন্সিতে দিলে নেগেটিভ ফ্রিকুয়েন্সি বেড়ে যাবে।
এবার আসুন আসল কথায়। আমরা প্রায় সবাই জানি ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি সময় ধীরে প্রবাহিত হয়। যার জন্য এর মহাকর্ষ বলের টান প্রচণ্ড। এখন ভাবুন তো সাধারণ বস্তু যদি ব্ল্যাকহোলের কাছে যায় তাহলে কী হবে? অবশ্যই বস্তুর জন্য সময় ধীরে চলবে। কিন্তু সেখানে যদি অ্যান্টিম্যাটার ফেলি? তার কী হবে? ভেবেছেন কখনো? তার জন্য সময় দ্রুত চলবে। শূন্যস্থানে ব্ল্যাকহোলের কথা চিন্তা করুন, একই কথা। ব্ল্যাকহোল তার চারপাশে শূন্যস্থানে থাকা কোয়ান্টাম ফিল্ডের পজিটিভ কম্পনগুলোকে ধীর করে দেবে (সময় ধীরে চললে ফ্রিকুয়েন্সি কমে যায়) আর নেগেটিভ কম্পনগুলোকে বাড়িয়ে দেবে। এতে আগে যে পজিটিভ নেগেটিভ উপরিপাতন ঘটিয়ে একে অপরকে নাকচ করছিল তা আর হচ্ছে না। তাই আপনি ব্ল্যাকহোলের চারপাশে শূন্যস্থানে দূর থেকে দেখতে পাবেন কণা-প্রতিকণার খেলা। এটাই হকিং রেডিয়েশন।
নতুন যে কণা-প্রতিকণা সৃষ্টি হলো এতে শক্তির সংরক্ষণশীলতা ভেঙে গেল না? না, ব্ল্যাকহোল তার শক্তি হারাবে ভররূপে। ভর হারিয়ে এর ক্ষেত্রফল হ্রাস পেতে থাকবে। হকিং দেখান, ক্ষেত্রফল তাপমাত্রার ব্যাস্তানুপাতিক। ব্ল্যাকহোল যত ছোটো হবে এর তাপমাত্রা তত বৃদ্ধি পাবে। একসময় গরম হতে হতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্ল্যাকহোল তার জীবন শেষ করবে। এবার বুঝলেন তো হকিং এর পেপারের নাম ‘Blackhole explosion’ কেন?
সবসময় হকিং রেডিয়েশন দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, মহাবিশ্ব একটি সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের চেয়ে গরম। তাই ব্ল্যাকহোল শূন্যস্থান থেকেও তাপ শোষণ করে। রেডিয়েশন সাধারণত করে না। যেগুলোর ভর কম তারা করতে পারে।
আরও একটি মজার ঘটনা হচ্ছে আপনি ব্ল্যাকহোলে পতিত হতে থাকলে হকিং রেডিয়েশন দেখবেন না। কারণ সময় আপনার জন্য তখন ঠিকঠাকই আছে। একমাত্র যারা দেখতে পায় যে ব্ল্যাকহোলের চারপাশে সময় ধীরে চলছে, তারাই দেখতে পারবে এই রেডিয়েশন।
হকিং রেডিয়েশনের এই ব্যাখ্যাটা কি একটু অন্যরকম লাগছে? ভার্চুয়াল পার্টিক্যাল নিয়ে আরেকটা ব্যাখ্যা ছিল না? আসলে হকিং এর পেপারের মূল প্রতিপাদন ছিল ফিল্ড নিয়ে। পরবর্তীতে একে সরলীকরণ করা হয় জনসাধরণের জন্য। যা হোক, ‘হকিং রেডিয়েশন করে ব্ল্যাকহোলের মৃত্যু’ এমন খবর হয়তো আমরা না-ও পেতে পারি। এর জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন সময় দরকার। এই রেডিয়েশন আসলে অনেক ধীর। আপাতত থিওরি, কল্পনা ও গাণিতিক সূত্র দিয়েই আমাদের হকিং রেডিয়েশনের পেছনে থাকা বিজ্ঞানের মজাটা লুফে নিতে হবে।