না। এই বারও হল না। আবারও হেরে গেলাম আমি জীবনের কাছে। আমাকে দিয়ে আসলে কিছুই হবে না। সমাজের নির্মম জাতাকলে পরে সামির মাথায় যখন এসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই সামি সিদ্ধান্ত নেয় এই জীবন আর রাখবে না। বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। কিন্তু সামি যদি জানতো তার দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজ এতটা মূল্যহীন নয় এমনকি স্বয়ং সাকিব আল হাসান অথবা শাহরুক খানকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম, তবে হয়তো সে জীবনকে আরও বেশি ভালোবাসতো আরও বেশি উপভোগ করত। হ্যাঁ। ঠিকই পরেছেন। শুধু সামি নয়, আপনার আমার সবার কাজ দ্বারাই আমরা সবাই প্রভাবিত। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বা Theory of Chaos. Butterfly effect হলো এই তত্ত্বেরই একটি ফলাফল। আর Butterfly Effect এর ফলাফল যে কত সূদরপ্রসারী তা বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের একটি কথায় বোঝা যায়,
একটি পেরেকের অভাবে জুতা ব্যবহার হলো না
বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন
জুতার অভাবে ঘোড়াও চলতে পারল না
ঘোড়ার অভাবে ঘোড়ার সহিসও থাকল না
ঘোড়ার সহিসের অভাবে যুদ্ধে জেতা গেলো না
যুদ্ধে হারার কারনে রাজত্ব হারিয়ে গেলো
শুধুমাত্র ঘোড়ার জুতার পেরেকের অভাবে
এত কিছু হলো
খুব ছোটোবেলায় আমরা সবাই এই কথাটি শুনেছিলাম। তবে এর মর্মার্থে যে বিজ্ঞানের এতো রহস্য লুকিয়ে আছে তা বোঝার সাধ্য ছিলো না। আজ এই বিজ্ঞানের রহস্য বোঝার ছোট্ট প্রয়াস করা যাক।
প্রথমেই একটু জেনে নেয়া যাক কি এই Chaos Theory? একটা গতিশীল বস্তুর বর্তমান অবস্থা জানা থাকলে আমরা নিউটনের সূত্রের সাহায্যে খুব সহজেই ভবিষ্যতের গতিপথ বলে দিতে পারি। যেমনঃ একটা বল কে নির্দিষ্ট বেগে ছুড়ে মারলে বলটি কতো দূরে কোথায় গিয়ে পরবে ইত্যাদি। মহাকাশের সব গ্রহ উপগ্রহের গতিপথ ও আমরা নিউটনের সূত্র দিয়ে খুব সহজেই বলে দিতে পারি। বিজ্ঞানের বেশিরভাগ ঘটনাই মোটামুটি গনিত নির্ভর, অনুমানযোগ্য এবং নির্দিষ্ট। যেমন- রাসায়নিক বিক্রিয়া, মহাকর্ষ, তড়িৎ বিজ্ঞান ইত্যাদি। কিন্তু একটা বেলুনের গতিপথ! নিউটনের সূত্র দ্বারা একটা বেলুনের গতিপথ অনুমান করা সম্ভব না। এখানেই উৎপত্তি ঘটে Chaos Theory। সিগারেটের ধোঁয়া অথবা কয়েলের ধোঁয়া কিছু সময় একটা order মেনে চললেও পরে তা বিশৃঙ্খল হয়ে পরে। এটাকেই বলে Chaos এবং এসকল ঘটনার বিজ্ঞান Chaotic system এর অন্তর্ভুক্ত।
এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগে মনে যে এই Chaos তো খুবই সাধারণ ঘটনা, এই নিয়ে এতো মাতামাতির কি আছে? আসলে বহু আগে থেকেই গণিতবিদদের Chaotic সমীকরণ সম্বন্ধে ধারনা ছিলো কিন্তু MIT এর আবহাওয়াবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ (Edward Lorenz) এর Butterfly effect এই Chaos Theory কে জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৬০ সালের কথা। এডওয়ার্ড লরেঞ্জ আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করছিলেন। ১২ টি সমীকরণ( যেমনঃ তাপমাত্রা, চাপ, আদ্রতা ইত্যাদি) ব্যবহার করে আবহাওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন গণনা করা শুরু করেন। তিনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে যে সকল সংখ্যা ব্যবহার করতেন, সেগুলো সাধারণত দশমিকের পর ছয় ঘর পর্যন্ত ছিলো। একদিন সময় বাঁচানোর জন্য তিনি দশমিকের পর তিন ঘর পর্যন্ত নিলেন। এই সামান্য পার্থক্যেই ঘটল লঙ্কা কাণ্ড! দুই ক্ষেত্রে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ছিল অনেক বড় রকমের ফারাক। এমনকি আবহাওয়ার পূর্বাভাসের গ্রাফের গতিপথেও ছিলো বড় ধরনের পার্থক্য!
এরপর বারবার বিভিন্ন দশমিক সংখ্যা দিয়ে লরেঞ্জ গ্রাফগুলোর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সামান্য কয়েক ঘর দশমিকের জন্যই গ্রাফের গতিপথে আসছিলো বড় ধরনের পার্থক্য। এরপর তিনি বুঝতে পারেন আমরা প্রতিনিয়ত অনেক ছোটখাটো ভুলগুলো করি যা পরবরতীতে আনতে পারে বৃহৎ কোনো পরিবর্তন বা বিশৃঙ্খলা। তার গ্রাফের গতিপথ ছিলো অনেকটা প্রজাপতির মতো। এ কারণে তার এই তত্ত্বের সাথে প্রজাপতির নাম জুড়ে গেছে। এটাকেই লরেঞ্জ “Butterfly Effect” বা “প্রজাপতি প্রভাব”বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে লরেঞ্জ তার গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিল “Does the Flap of a Butterfly’s wing in Brazil Set Off a Tornado in Texas? (ব্রাজিলের একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোয় টেক্সাসে কি টর্নেডো হয়?)”
Chaos কে আরও ভালোভাবে জানতে হলে attractor সম্পর্কে জানা অত্যাবশ্যক। সময়ের সাথে কোনো বিন্দুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটলে আমরা বলতে পারি ঐ বিন্দুটি গতিশীল। কোনো ব্যবস্থাতে যে সকল বিন্দুগুলো থাকে সেগুলো যদি গতিশীল হয় তখন আমরা তাকে বলতে পারি গতীয় ব্যবস্থা। এখন এই গতিশীল বিন্দুগুলো অন্য যে সকল বিন্দুর আশেপাশে বেশি ঘুরাঘুরি করে, সেগুলো হলো আকর্ষক বা attractor। একটা উদাহরন দেয়া যাক। আমাদের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শীত থাকে জানুয়ারী মাসে। কিন্তু কত বেশি শীত? আমরা পুরোপুরি সঠিক তাপমাত্রা না বলতে পারলেও (যেহেতু এটি একটি chaotic সিস্টেম) মোটামুটি অনুমান করে বলতে পারি যে এই তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস মধ্যে হতে পারে। তাই বলা যায়, ১৫ ও ২৬ এক্ষেত্রে হতে পারে attractor।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে Butterfly effect এর সাথে attractor এর সম্পর্ক কি? এডওয়ার্ড লরেঞ্জের গ্রাফে X, Y, Z অক্ষ বরাবর আর্দ্রতা, বায়ুচাপ আর তাপমাত্রা কে ধরে নেওয়া হয়েছিলো, এরা সময়ের সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল এবং এটি একটি গতিশীল ব্যবস্থা। এই গতিশীল ব্যবস্থায় তিনি কোনো একটি দিনের আর্দ্রতা, বায়ুচাপ আর তাপমাত্রাকে সমীকরনে বসান এবং দেখতে চান যে সময়ের সাথে পরবর্তী দিন গুলোতে আবহাওয়ার গতিপথ কেমন হয়? তিনি দেখেন যে একটি গতিশীল বিন্দু একটি attractor এর আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই attractor পরিবর্তন করে ফেললো। তার মানে বোঝা যায় যে এডওয়ার্ড লরেঞ্জ আবহাওয়ার যে গ্রাফটি তৈরি করেছিলেন তাতে দুইটি প্রজাপতির দুটি পাখায় দুটি attractor ছিলো। কিন্তু ঠিক কখন এই বিন্দু টি অপর attractor কাছে চলা শুরু করবে তা একেবার ই অনুমান করা যায় না। Chaotic ব্যবস্থার সাথে আকর্ষকের এই সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া ছিলো Chaos তত্ত্বের অন্যতম সাফল্য। Attractor এর মাধ্যমে chaotic system এর কোনো ভবিষ্যৎ না জানা গেলেও মোটামুটি সীমারেখা অনুমান করা যায়। এডওয়ার্ড লরেঞ্জের এই attractor টির চারপাশে বিন্দুর চলাচল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এটি অনেকটা প্রজাপতির আকৃতির মতো। তবে attractor নানা রকমের হতে পারে। যেমন Lorenz attractor, The TSUCS 2 Attractor ইত্যাদি।
কিন্তু বিজ্ঞানী বলে কথা, তিনি এই বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা করতে লাগলেন, এবং দেখলেন কোনো কিছুর initial condition কে পরিবর্তন অর্থাৎ এখানে আমরা যদি তাপমাত্রা, আদ্রতা ইত্যাদির মান সামান্যও পরিবর্তন করে দেই (হতে পারে ১ কোটি ভাগের ১ ভাগ) তাহলে পুরোপুরি ভিন্ন সময়ে বিন্দুটি লুপ পরিবর্তন করবে এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। অর্থাৎ initial condition এর সামান্য পার্থক্য ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে ৫/৬ দিনের বেশী আগে কোনো স্থানের আবহাওয়ার পূর্বাভাস আমরা কখনই দিতে পারি না।
এই কারণেই ছোট কোনো ঘটনার প্রভাবও অনেক সময় হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একজন ব্রিটিশ সৈন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আহত জার্মান সৈন্যকে হত্যা না করে ছেড়ে দেন। সেই জার্মান সৈন্য আর কেঊ নন বরং এডলফ হিটলার। বাকীটা ইতিহাস! সবসময় ছোট কোনো ঘটনার প্রভাব যে খারাপই হবে তা নয়। ভালো কিছুও হতে পারে। যেমন ধরুন নিউটনের মাথায় আপেল পরা টা। অন্য কেউ হলে আপেল পরায় হয়তো তেমন কিছু মনে করতো না। কিন্তু নিউটনকে দেখুন, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তাই নিজেকে বা নিজের সাথে ঘটে যাওয়া কোনো কাজকে ছোট করে দেখা যাবে না। হয়তো আমি আপনি এই মুহূর্তে যে কাজটি করছি তা পরবর্তীতে আমাদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন করে তুলবে। তাই নিজেকে ভালবাসুন, নিজের কাজকেও ভালবাসুন।