লেখক : কে. এম. শরীয়াত উল্লাহ
সৌরজগতের গ্রহগুলোর চিত্র যখন আমরা কল্পনা করি তখন আমাদের চোখের সামনে নানান গ্রহকে চেনার নানান উপায় থাকে। লাল গ্রহ মানেই মঙ্গল, পৃষ্ঠে একটি বিশাল লাল রঙের ছোপ দাগ থাকলেই বৃহস্পতি আর গ্রহের পাশে একটি রিং থাকলেই তাকে আমরা শনি গ্রহ নামে চিনি। যদিও আমাদের সৌরজগতে শনি ছাড়াও বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনেরও বলয় বা রিং বিদ্যমান। তবে তাদের রিং শনির মত এত সহজে দেখা যায় না। এখন পর্যন্ত পাইয়োনিয়ার ১১, ভয়েজার ১, ভয়েজার ২ ও ক্যাসিনি মিশনের সাহায্যে শনির বলয় পর্যবেক্ষণ করা হয়।
১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি তার তৈরি করা টেলিস্কোপের সাহায্যে শনি গ্রহকে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি শনি গ্রহের দুইপাশে দুটি অস্পষ্ট বস্তু দেখতে পান। এই দুইটি বস্তুকে গ্যালিলিও মনে করেছিলেন শনি গ্রহের দুইটি কান। ১৬১১ সালে এই দুই বস্তুকে গ্যালিলিও গায়েব হয়ে যেতে দেখলেন। তিনি ভাবলে পৌরানিক কাহিনীর মত স্যাটার্ন তার সন্তানদের গিলে ফেলল না তো? এর পরের বছর তিনি আবার ঐ দুই বস্তুকে দেখতে পান।
১৬৫৫ সালে বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস বলেন, গ্যালিলিও যে বস্তু গুলোকে দেখেছেন সেগুলো আসলে কোনো উপগ্রহ বা এরকম কিছু না। এগুলো আসলে শনি গ্রহের চারপাশে থাকা একটি বলয়ের অংশ। কেন এ বলয় তৈরি হয় তার একটি গাণিতিক ব্যাখ্যা অবশ্য এসেছিল এরও প্রায় ২০০ বছর পর, এডওয়ার্ড রশ নামক এক ভদ্রলোক এই গাণিতিক ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলেন।
১৬৭৫ সালে বিজ্ঞানী জিওভান্নি ক্যাসিনি তার টেলিস্কোপ দিয়ে শনি গ্রহের রিং পর্যবেক্ষণের সময় আবিষ্কার করেন, আমরা এতোদিন যে ভাবতাম এখানে একটাই রিং, আসলে এখানে রিঙয়ের মাঝে একটি ছোট গ্যাপ আছে। এই গ্যাপটাকে আজ আমরা ক্যাসিনি ডিভিশন নামে চিনি। পরে বিজ্ঞানী রশ আরেকটি গ্যাপ আবিষ্কার করেন যাকে রশ ডিভিশন নাম দেওয়া হয়। বর্তমানে আমরা শনি গ্রহের বলয়ে এরকম সাতটি ডিভিশন দেখতে পাই। এদেরকে A Ring, B Ring, C Ring, D Ring, E Ring, F Ring, G Ring নামে চিহ্নিত করা হয়। এ ও বি এর মাঝের ডিভিশনটিই ক্যাসিনি ডিভিশন।
পর্যবেক্ষণ থেকে ডিভিশনগুলো আবিষ্কার হলেও কেন এই ডিভিশনগুলো সৃষ্টি হয়েছে তার গাণিতিকি ব্যাখ্যা তখনো বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ফ্লুইড ডায়নামিক্সের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন এই ডিভিশনগুলো।
রিং সৃষ্টির কারণ – রশের লিমিট
ধরুন, চাঁদ এখন যেখানে আছে, সেখান থেকে পৃথিবীর দিকে আরেকটু বেশি চলে এলো। তাহলে চাঁদের জন্য যেমন পৃথিবীর জোয়াড় ভাটা হয়, পৃথিবী আকর্ষণের জন্যও চাঁদের একদিন ও বিপরীত দিক সামান্য চ্যাপ্টা হয়ে যায়। যদি আরো বেশি কাছে আসে, তাহলে চাঁদের নিজের মাধ্যাকর্ষণ বল, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল থেকে কমে যায় ও ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। ফলে চাঁদ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় ও এর ধ্বংসাবশেষ একটি কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। এভাবেই মূলত বলয়ের সৃষ্টি হয়। গ্রহ থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে ঢুকে পড়লেই চাঁদ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। সর্বনিম্ন এই দূরত্বকেই রশের লিমিট বলে।
লিমিটের মান নির্ণয়
ধরুন s ব্যাসার্ধের একটি গ্রহের (M) ভরকেন্দ্র থেকে এর চারপাশে ঘুর্ণায়মান r ব্যাসার্ধের একটি উপগ্রহের (m) ভরকেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব R । তাহলে উপগ্রহের পৃথিবীর দিকে মুখ করা পৃষ্ঠের ও পৃথিবীর থেকে উলটো দিক মুখ করা পৃষ্ঠের মাঝে মহাকর্ষ বলের পার্থক্য হবে,
\Delta F = GMm \left( \frac{1}{(R-r)^2} -\frac{1}{(R+r)^2} \right)
R>>r হলে,
\Delta F = GMm \frac{4r}{R^3}
পৃথিবীর দিকে মুখ করা পৃষ্ঠের ও পৃথিবীর থেকে উলটো দিক মুখ করা পৃষ্ঠের মাঝে মহাকর্ষ বল,
F' = G \frac{m^2}{4r^2}
যদি ∆F > F’ হয় তাহলে গ্রহটি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তাহলে সর্বনিম্ন দূরত্ব বের করার জন্য
\Delta F = F' \\ \Rightarrow GMm \frac{4r}{R^3} = G \frac{m^2}{4r^2} \\[.5em] \Rightarrow R = \sqrt[3]{16r^3 \frac{M}{m}} \\ \Rightarrow R = 2.5s
এটাই রশের লিমিট। অর্থাৎ, গ্রহের ব্যাসার্ধ্যের আড়াই গুণ দূরত্বের মধ্যে কোনো উপগ্রহ ঢুকে পড়লে তা বলয়ে পরিণত হয়ে যাবে।